Tuesday, August 12, 2014

একজন অপরিচিত সেলিব্রিটি (ওয়াইস আল কারনি)

একজন অপরিচিত সেলিব্রিটি (ওয়াইস আল কারনি)
...................................................................................................................

আমিরুল মুমিনিন ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) দাঁড়িয়ে আছেন ইয়েমেন থেকে আগত দলটির সামনে। এই দলটি ইয়েমেন থেকে মদিনা হয়ে যাবে ইরাক ও আশ-শাম-এর দিকে। ওমর (রাঃ) তাদেরকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেনঃ “ হে ইয়েমেনবাসী!! তোমাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছ যার নাম ওয়াইস।”

প্রশ্নটি করে ওমর(রাঃ) অপেক্ষা করছেন। অনেক দিন থেকেই ইয়েমেনের এই ব্যক্তিটিকে খুঁজছেন তিনি, প্রতিবারই ইয়েমেন থেকে কোনো কাফেলা আসলে ওমর (রাঃ) তাদেরকে ওয়াইস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু এই ব্যক্তি সম্পর্কে কেউ কোনো তথ্য দিতে পারে না। প্রতিবারই তাঁকে হতাশ হতে হয়। 

আজকে অবশ্য খলিফা ওমর (রাঃ)-এর প্রশ্ন শুনে একজন দাঁড়ালেন। বয়সে বৃদ্ধ , বিশাল দাঁড়ি। তিনি ওমর (রাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ “ আপনি কোন ওয়াইস এর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছেন সেটা তো জানি না, তবে আমার ভাই-এর ছেলের নাম ওয়াইস। কিন্তু তার ব্যাপারে তো জিজ্ঞেস করার প্রশ্নই আসে না, সে তো এমন কেউ না; বরং সে এতোই গরিব এবং এতোই নতমস্তক যে, আপনার পরিচিত হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সে আমাদের উটগুলোর দেখাশোনা করে। এমনকি আমাদের মধ্যেও তার কোন বিশেষ স্থান নেই।” 

বৃদ্ধের কাছে ওমর (রাঃ) ওয়াইস সম্পর্কে আরও জানতে চাইলেন। 

বৃদ্ধ বললঃ হে আমিরুল মুমিনিন! কেন আপনি তার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন? আল্লাহর কসম, তার মতো এতো বোকা আর এতো হতদরিদ্র আমাদের মধ্যে আর কেউ নেই।

বৃদ্ধের এই কথা শুনে ওমর (রাঃ) তার চোখের পানি আটকাতে পারলেন না। অঝোরে কেঁদে দিলেন। তার কান্না গোপন রইলো না। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেনঃ “ তুমি হত দরিদ্র - সে না । কারণ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, ‘রাবিইয়া’ আর ‘মুজার’ গোত্রের লোক সংখ্যার মতো মানুষকে আল্লাহ ওয়াইস-এর সুপারিশের উসিলায় মাফ করে দেবেন এবং জান্নাতে প্রবেশ করাবেন।এখন আমাকে বল, কোথায় সে?” বৃদ্ধ বললঃ আরাফা’র চূড়ায় আছে সে। ওমর (রাঃ) আলী (রাঃ)কে নিয়ে দ্রুত আরাফায় গেলেন। ঐ তো একটা গাছের নিচে বসে ইবাদত করছেন ওয়াইস, তার চারপাশে অনেক উট। ওমর (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) তাঁর সামনে গেলেন, তাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আসসালামু ওয়ালাইকুম।

ওয়াইস তাঁর ইবাদত শেষ করে তাঁদের দিকে ফিরে সালামের উত্তর দিলেন।

তাঁরা তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ কে তুমি?

সে বললঃ আমি উট দেখাশোনা করি এবং একটি গোত্রের কাজের লোক।

তাঁরা বললেনঃ আমরা তোমাকে তোমার পশু পালনের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করিনি, এমনকি তুমি কোনো গোত্রের কাজের লোক কিনা তাও জানতে চাইনি; আমরা জানতে চাচ্ছি তোমার নাম কী? 

সে বললঃ আব্দুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা)।

তাঁরা বললেনঃ এই আসমান এবং জমিনে যতো আল্লাহর সৃষ্টি আছে সবই আল্লাহর বান্দা; কিন্তু তোমার নাম কী যা দিয়ে তোমার মা তোমাকে সম্বোধন করেন?

সে বললঃ তোমরা আমার কাছে কী চাও? 

তাঁরা বললেনঃ “ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার আমাদেরকে ওয়াইস আল কারনি নামে এক ব্যক্তির কথা বলেছিলেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী সেই ব্যক্তির থাকবে নীলাভ কালো চোখ এবং তার বাম কাঁধের নিচে এক দিরহামের মতো একটি সাদা দাগ থাকবে। তাই দয়া করে আমাদেরকে দেখতে দাও যে তোমার ঐ সাদা দাগটি আছে কিনা। তাহলেই আমরা বুঝবো আমরা যাকে খুঁজছি সে তুমি কি না?
ওয়াইস তখন তার বাম কাঁধ উন্মুক্ত করে দেখালেন, দিরহামের মতো সেই সাদা দাগটি স্পষ্ট ফুটে আছে তার বাম কাঁধের নিচে। ওমর (রাঃ) এবং আলী (রাঃ)-র বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এই সেই ওয়াইস আল কারনি যার কথা অনেক অনেক বছর আগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বলেছিলেন।

তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত। তিনি একটি হাদিসে কুদসি বর্ণনা করেছিলেন (আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত হয়েছে হাসিদটি) যেখানে তিনি বলেন যে, আল্লাহ বলেনঃ “আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতালা ভালোবাসেন তাঁর সৃষ্টিকে যে আল্লাহ ভীরু, যার অন্তর পরিশুদ্ধ, তাদেরকে যারা নিজেদের গোপন রাখে এবং তাদেরকে যারা নিরপরাধ, যার মুখমন্ডল ধূলো-মলিন, যার চুল এলোমেলো, যার পেট খালি এবং সে যদি শাসকের সাথে দেখা করার অনুমতি চায় তাহলে তাকে তা দেয়া হয় না। এবং সে যদি একটু সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে বিয়ে করতে চায় তাহলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং সে যদি দুনিয়ার কিছু ত্যাগ করে এর অভাব কখনোওই সে বোধ করে না। এবং সে যদি কোথাও থেকে বের হয়ে যায় তাহলে তার বের হয়ে যাওয়াও কেউ লক্ষ্য করে না। সে যদি অসুস্থ হয়, তাহলে তাকে দেখতে কেউ আসে না এবং সে যদি মারা যায় তাহলে তাকে কবর পর্যন্ত পৌঁছে দিতেও কেউ আসে না।”

এই হাদিস শুনে সাহাবারা (রাঃ) তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ 

“ইয়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, এরকম একজন ব্যক্তিকে আমরা কিভাবে খুঁজে পাবো?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেনঃ ওয়াইস আল কারনি হচ্ছে এমনই একজন ব্যক্তি।

তখন সাহাবারা (রা) জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ কে এই ওয়াইস আল কারনি?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেনঃ তার গাত্র বর্ণ কালো, কাঁধ প্রশস্থ, উচ্চতা মাঝারি, তার দাঁড়ি তার বুক পর্যন্ত লম্বা, তার চোখ সবসময় অবনমিত থাকে সেজদার স্থানে। তার ডান হাত থাকে তার বাম হাতের ওপর। সে একান্তে এমনভাবেই কাঁদে যে তার ঠোঁট স্ফীত হয়ে যায়। সে একটি উলের পোশাক পরে এবং আসমানের সবাই তাকে চেনে। যদি সে আল্লাহর নামে কোনো শপথ করে, সে তা পালন করে। তার ডান কাঁধের নিচে একটি সাদা দাগ রয়েছে। যখন আখেরাতের দিন আসবে এবং আল্লাহর বান্দাদেরকে বলা হবে জান্নাতে প্রবেশ কর, তখন ওয়াইসকে বলা হবে ‘দাঁড়াও এবং সুপারিশ কর’ আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতালা তখন তার সুপারিশ অনুযায়ী ‘মুজির’ এবং ‘রাবিয়া’ (ওয়াইসের দুই গোত্রের নাম) গোত্রের লোক সংখ্যার সমান লোককে ক্ষমা করে দেবেন । সুতরাং হে ওমর এবং আলী, তোমরা যদি কখনও তার দেখা পাও তাহলে তাকে বলো তোমাদের জন্যে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করতে, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করবেন।”

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াইস সম্পর্কে আরো বলেছিলেন যে, তার ঘরে বৃদ্ধা মা আছে। যার পুরো দেখা শোনা ওয়াইস করেন এবং বৃদ্ধা মাকে দেখা শোনার জন্যে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহনের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দেখা হওয়ার যে সুবর্ণ সুযোগ ছিল তা গ্রহন করতে পারেনি। 

(ওয়াইস আল কারনি তার মায়ের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাসুলুল্লাহ(সাঃ)এর সাহাবি হওয়ার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হন। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবদ্দশায় ইসলাম কবুল করলেও তিনি তাবেয়ি রয়ে যান।)  

এই ঘটনার পর প্রায় দশ বছর কেটে গেছে।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর তাদের মাঝে নেই। আবু বকর (রাঃ)ও দুনিয়া ছেড়েছেন। এর মধ্যে শত খোঁজার পরও ওয়াইস আল কারনিকে খুঁজে পাননি তাঁরা। আর আজকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বর্ণনাকৃত সেই ওয়াইস আল কারনি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।

ওমর (রাঃ) এবং আলী (রাঃ) ওয়াইস আল কারনিকে জড়িয়ে ধরে বললেনঃ “আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমিই সেই ওয়াইস আল কারনি। সুতরাং আল্লাহর কাছে আমাদের জন্যে ক্ষমার সুপারিশ কর এবং আল্লাহ তোমাকেও ক্ষমা করুন।”

উত্তরে ওয়াইস বললেনঃ কোনো আদম সন্তান বা নিজেকে আমি ক্ষমা করানোর ক্ষমতা রাখি না , তবে এই জমিনে ইমানদার পুরুষ এবং ইমানদার নারী রয়েছে, মুসলিম নারী মুসলিম পুরুষ রয়েছে, যাদের দোয়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। 

তাঁরা বললেনঃ সত্যিই তাই।

তখন তিনি বললেনঃ আপনারা দুজন আমার সম্পর্কে জানেন এবং আমি আমার অবস্থান সম্পর্কে জানি কিন্তু আপনারা কারা?

আলী (রাঃ) তখন ওমর (রাঃ)কে দেখিয়ে বললেনঃ ইনি হচ্ছেন আমিরুল মুমিনিন ওমর বিন খাত্তাব (রাঃ) এবং আমি হচ্ছি আলী বিন আবু তালিব।

ওয়াইস তাদের পরিচয় শুনে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং তাদের উদ্দেশ্য করে বললেনঃ আসসালামু ওয়ালাইকুম ইয়া আমিরুল মুমিনিন এবং আলী আপনাকেও। আল্লাহ আপনাদেরকে এই উম্মাহর জন্যে উত্তম প্রতিদান দান করুন।

তাঁরাও বললেনঃ আল্লাহ তোমাকেও উত্তম প্রতিদান দিন।

এর পর ওয়াইস আল কারনি তাদের জন্যে দোয়া করলেন।

ওমর (রাঃ) ওয়াইস আল কারনিকে বললেনঃ “ তুমি এখন ইহজীবন এবং পরকালে আমার বন্ধু।”

ওয়াইস আল কারনি জানেন ইহজীবনে ওমরের বন্ধু হওয়া মানে সুনাম এবং একটি স্বচ্ছল জীবন, তাই তিনি ওমর (রাঃ)এর বন্ধুত্ব তো গ্রহন করলেন কিন্তু খুব বিনয়ের সাথে তার সাথের স্বচ্ছলতা এবং সুনাম যা ওমর (রাঃ) এর মাধ্যমে সে পেতে পারত, সেটা প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি যেমন আছেন ঠিক তেমনই থাকার ইচ্ছে পোষণ করলেন। 

ওমর (রাঃ) বলেনঃ তুমি কোথায় যেতে চাও এখন? ওয়াইস আল কারনি বলেনঃ ইরাকের কুফায়।

ওমর(রাঃ): ঠিক আছে আমি একটি চিঠি লিখে দেই কুফার গভর্নরকে যাতে সে তোমার ভালো দেখাশোনা করতে পারে। 

ওয়াইস বললেনঃ দয়া করে এই কাজ করবেন না। কারণ আমি নিজেকে এইভাবে অচেনা রাখতেই পছন্দ করি। আমি আল্লাহর রাস্তায় এভাবেই অপরিচিত হয়েই থাকতে চাই।

এরপর সে কুফায় চলে যায়। সেখানেই বসতি স্থাপন করে। এইভাবে কেটে যায় আরও কিছু বছর। একবার কুফা থেকে ওয়াইস আল কারনির গোত্রের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি মদিনায় আসেন। তার কাছে ওমর(রাঃ) ওয়াইস আল কারনি কেমন আছেন তা জানতে চান। খলিফা ওয়াইস আল কারনির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছে দেখে সেই ব্যক্তি খুব অবাক হয় , সে খালিফা ওমর (রাঃ)কে উদ্দেশ্য করে বলেঃ আমি তাকে দরিদ্রতায় নিমজ্জিত দেখে এসেছি্‌ ,তার ঘরে কোনো আসবাব নেই, কেন আপনি এই ব্যক্তির কথা জিজ্ঞেস করছেন।

ওমর (রাঃ) এই ব্যক্তিকে বললেনঃ যদি তুমি তার দেখা পাও , তাকে বলো তোমার জন্যে দোয়া করতে কারণ রাসুলুল্লাহ (সাঃ) তার কথা বলেছিলেন। 

সেই ব্যক্তি কুফায় ফিরে ওয়াইসের সাথে দেখা করে। তাকে বলেঃ ওয়াইস আমার জন্যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর।

ওয়াইস বললেনঃ তুমি নিজে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। কারণ তুমি মাত্র সফর করে আসলে। আর মুসাফিরের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।

সে বললঃ না না। আমি চাই তুমি আমার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা কর।

ওয়াইস আল কারনি একটু চুপ থাকলেন তারপর বললেনঃ“তোমার কি ওমরের সাথে দেখা হয়ে ছিল?”

সে বললঃ হ্যাঁ।

ওয়াইস আল কারনি বুঝতে পারলেন কী হয়েছে ব্যাপারটা। তিনি কিছু বললেন না। ঐ ব্যক্তির জন্যে দোয়া করলেন।

এই ঘটনা পুরো কুফায় আগুনের মত ছড়িয়ে পড়ল , সবাই জেনে গেল ওয়াইস আল কারনি সম্পর্কে । নিজেদের আল্লাহর দরবারে মাফ করিয়ে নিতে মানুষজন যখন ওয়াইসের খোঁজে তার বাড়ি গেল , দেখলো বাড়ি খালি পড়ে আছে-ওয়াইস নেই। নাম, যশ, খ্যাতি সব কিছু দুহাত দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে একমাত্র আল্লাহর জন্যে বেঁচেছেন তিনি। তার তাকওয়া, তার মর্যাদা তিনি কারো কাছে প্রকাশ করতে চাননি। একমাত্র আল্লাহর জন্যেই সব করেছেন এবং আল্লাহর কাছ থেকেই ইনশাআল্লাহ তিনি এর বিনিময় পাবেন, সত্যি ওয়াইস আল কারনি একজন অপরিচিত সেলিব্রিটি।

আল্লাহ আমাদের সকল কথা এবং কাজকে সঠিক ইখলাসের চাদর দিয়ে ঢেকে দিন। আমিন।



পর্যবেক্ষণ - ২ : টিভির অ্যাড




টিভির অ্যাড গুলো কি আমাদের মাথা খাচ্ছে? 


প্রারম্ভিকা: 

আসসালামু আলাইকুম আমি সাধারণত টিভি দেখি না বললেই চলে আলহামদুলিল্লাহ টিভি অ্যাড সংক্রান্ত আমার লেখাটি অনেকে শেয়ার করেছেন বলে অনেক ধন্যবাদ সেই সাথে অনেক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে বলে দুঃখিত অনেকেই ভুল ভেবে বসেছেন আমাকে হঠাৎ টিভির পর্দায় পরপর এসব দেখেই লেখা আর মানুষকে সচেতন করার জন্যই লেখা অন্য কোন অসৎ নিয়্যাহ ছিল না আপনি যদি সমাজের অসংগতি নিয়ে কিছু বলতে চান তাহলে আপনাকে তা গভীরভাবে খেয়াল করতে হবে বিশ্লেষণ করতে পারবেন না এটা ছাড়া মানুষকে বুঝাতেও পারবেন না আপনি আমরা যারা লেখালিখি করি, কোন লাইক/কমেন্ট কামাই করার জন্য লিখি না ইচ্ছা একটাই বদলে দেব, দুঃখ একটাই, এমন জেনারেশন চাইনি, চাইব না ভবিষ্যতে একমাত্র আল্লাহর জন্য, এসব লেখা না হলে আমার মহামূল্যবান সময় নষ্ট করে ফেসবুকে এসব লেখার কোন ফায়দা নাই আসলে চুপ থেকে সব দেখে গেলেই তো চলত! সমালোচনা সহ্য করা যায়, কিন্তু না জেনে না বুঝে সমালোচনা করাটা পছন্দনীয় না 




# ফেয়ার এন্ড লাভলির বদৌলতে এতদিন শুনতাম এটা আসলেই রং ফর্সা করে আর এদের মার্কেটের টার্গেট হল মেয়েরা একটু শ্যামলা মেয়েরা রং ফর্সার জন্য অহেতুক না বুঝে ব্যবহার শুরু করে দিল মার্কেটটাকে আরো চওড়া করতে এবার তারা নিয়ে এল ম্যানজ একটিভ ছেলেদের ক্রিম মানে ক্রিম ডলে ডলে ছেলেদের ফর্সা করবে আবার এর সাথে মাঝে মাঝে রেজারও ফ্রি দেয়া হয় মার্কেটিং পলিসি কত প্রকার কি কি, এসব আইডিয়া দেখলেই বুঝা যায় তার মানে কি দাড়াঁলো? এতদিন যে ছেলেটা ক্রিম ডলল মুখে, এটাতে হবে না মুখে 'চুল' ওঠা মাত্রই তাকে সাবাড় করতে হবে দাড়িঁ দিয়ে মুখভরা থাকলে তো সৌন্দর্য বুঝা যাবেনা সৌন্দর্য বুঝাতে হলে পুরা মুখ ক্ষুর দিয়ে পরিষ্কার করে ফকফকা করতে হবে! এজন্য ক্রিমের সাথে রেজার ফ্রি! আহা! 


ফলাফল: ইয়ং জেনারেশন, মেয়েরা সুন্দরী হবার প্রতিযোগিতায় নামল, আর ছেলেরা নামল কিভাবে মুখটাকে ফর্সা আর মসৃণ করা যায় মুখটা বন-জঙ্গলে ভরে থাকলে ক্লাসের সেই মেয়েটা তাকে লাইক করবে না তো! 



# মেরিল স্প্লাশ উনারা কখনোই তরুণ তরুণীদের ফর্সা করতে নামেননি মূলত বানান ট্যাল্কম পাউডার, সাবান, লোশন এসব মার্কেটে টিকতে এবার তারা নিয়ে এলেন নতুন আইডিয়া 'সুন্দর প্রকাশ পায় না রংয়ে' 'শ্যামলা কালো ফর্সা' সবই সুন্দর তাই ইউনিভার্সাল সল্যুশন নিয়ে এলেন তারা ফ্রেশ থাকতে হবে তুমি যতই কালা-ধলা হও না কেন? এবারের টার্গেট যথারীতি -- তরুণীরা 


ফলাফল: এবার ফ্রেশনেসের জন্য ব্রেইনওয়াশড তরুণীরা 

ভাই থামেন! আপনাদের মত করেই বলতে চাই ফ্রেশ চিন্তা করুন বাহ্যিক সৌন্দর্যে কি হবে যদি না আপনার অন্তর কলুষিত হয় ছেলেমেয়ে সবার ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য অনেক বোন হীণমন্যতায় ভোগেন 'আমি তো কালো/শ্যামলা' তারপরই শয়তানের বানানো ফর্মুলায় নিজেকে সপেঁ দেন বোন আমার, আপনার অন্তর পবিত্র করুন বাইরের সৌন্দর্যে কি কোন লাভ হবে আসলেই চিন্তা করুন তো! আপনি চিন্তা করছেন-- আপনার বিয়ে হবে না তাই এসব ইউজ করছেন আল্লাহ চান তো নিজেকে প্রস্তুত করেন যার সাথে আপনার দেখা হবে তার জন্য তিনি যদি আসলেই ঈমানদার হন, তিনি আপনার অন্তরের রূপই দেখবেন, আখলাক দেখবেন গায়ের রং না সঙ্গী নির্বাচনের শর্ত তো বলেই দিয়েছেন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) হাদিসে দেখুন তো কি বলা হয়েছে সবার আগে সৎ চরিত্র, তারপর বংশমর্যাদা, তারপর সৌন্দর্য হতাশ হচ্ছেন কেন? চরিত্র, অন্তর পবিত্র করুন দুনিয়ার এসব বস্তু ব্যবহারে আপনার আখিরাতের শান্তির জন্য কোন ফায়দা হবে না সিরিয়াসলি! 


# সার্প ব্লেড উনারাও তরুণদের মুখ কিভাবে মসৃণ করা যায় তার পিছে লেগেছেন ব্যবসা করেছেন অ্যাডে যা দেখি তা মূলত এমন-- 


ভার্সিটির এক সুন্দরী ছাত্রী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন ছেলেরা ফিরে ফিরে তার দিকে বারবার তাকাচ্ছেন যে ছেলেটার পাশে বসা একটা মেয়ে সেও ভুলে তাকাচ্ছে মেয়েটা মুখ তার দিকে ফিরিয়ে নেয়ার বৃথা চেষ্টা করছে এবার সুন্দরীর মুখে আলো এসে পড়ল সে বেচারা ঝলকানিতে তাকাতেই পারছেনা দূরে দেখা গেল হাস্যোজ্জ্বল এক যুবক স্বীয় গালে হাত বুলাতে বুলাতে হাসছেন আলোর ঝলকানিটা তার মুখ থেকেই ঠিকরে বের হচ্ছে 

অ্যাডটা এবার খেয়াল করুন প্রথমে কি দেখানো হল আর শেষে কি দেখানো হল প্রথমে নারী রূপ দেখিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, পুরুষেরা মন্ত্রমুগ্ধ শেষে সেই নারী আরেক পুরুষের রূপে মন্ত্রমুগ্ধ গভীরভাবে যদি চিন্তা করেন তাহলে দেখবেন এখানে মেয়েটা একটা 'শো পিস' হিসেবেই ইউজ হল আর মূল ঘটনা হল ক্লিনসেইভড ছেলেটা অতঃপর এসব দেখে দেখে আমাদের তরুণসমাজ তা অনুকরণে ব্যস্ত 'আরে! মেয়েটা তো আমার দিকে তাকাইসেরে, সেইভ কইরা সফল আমি' - এমন তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলায় ব্যস্ত 

ফলাফল: এবারও ব্রেইনওয়াশড তরুণেরা সাথে নারীদের 'শো পিস' হিসেবে ব্যবহার করে পুরুষের মনোরঞ্জনের চেষ্টা 


আজকাল টিভি-চ্যানেলের ৩টি জনপ্রিয় অ্যাড নিয়ে এতক্ষণ কথা বললাম ফলাফল বললাম সম্ভাব্য সমাধান কি হতে পারে তাও বললাম একটু চিন্তা করেন- আল্লাহর এই দুনিয়ায় ব্যবসা করার মত হাজারো ভাল চিন্তা আছে, ক্ষেত্র আছে আর এরা যে এসব উদ্ভট উদ্ভট আইডিয়া বের করে আমাদের ইয়ং জেনারেশনটাকে শেষ করে দিচ্ছে- বলুনতো এদের ব্যবসা কি হালাল নাকি হারাম? 

আল্লাহ আমাদের সবাইকেই চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা দিয়েছেন এখন আমরা যদি এটা কাজে না লাগিয়ে গাধার মত এসব আবর্জনার পিছে ছুটি, ক্ষতিটা কার হচ্ছে? আমাদেরই কিন্তু তাই কোথাও ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে সপেঁ দেবার আগে একটু চিন্তা করুন 

মাথায় যদি একটু ঘিলুও আল্লাহ দেন, তাহলে উপরের কাহিনীগুলো বুঝতে পারবেন ইন শা আল্লাহ 

আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তা'আলা এসব দুইনম্বরী জিনিসে ব্রেইনকে কাজে না লাগিয়ে ভালো কাজের পিছনে কাজে লাগানোর তৌফিক দিন এবং নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রত্যেকের চেষ্টাসমূহকে কবুল করে নিন আমিন 

জাজাকআল্লাহ খাইরান 

২রা শাওয়াল, ১৪৩৫ হিজরী 

৩০ জুলাই, ২০১৪ খ্রিস্টাব্দ