بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
মুখবন্ধ:
লেখার প্রথমেই বলে রাখি আমি কোন স্কলার নই। একজন একাডেমিক মাত্র। আপনারা যা জানেন তার চেয়ে কিছু বেশি অথবা কম জানি। আশেপাশে যা-ই দেখি তা-ই পড়ে দেখি। শবে বরাত নিয়ে আমার খুব কৌতূহল ছিল। তাই সেটা দমাতে না পেরে এর অথেনটেসিটি নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করলাম। বিস্তর লেখাপড়া করার পর একটা বড়সড় ধাক্কা খেলাম। বুঝতে পারলাম আমরা উপমহাদেশীরা কি রকম ভুলের মধ্যে আছি! না জেনে না বুঝে একটা ভুল জিনিস শত শত বছর ধরে পালন করছি! আমরা উপমহাদেশের মুসলমানগন পনের শাবানের রাতে শবে বরাত নামে যে আচার-আনুষ্ঠান উদযাপন করে থাকি, তা আদৌ শরিয়তসিদ্ধ নয়। আল-কুরআনুল কারীম ও সহীহ হাদীসে এ রাতের বিশেষ কোন আমলের কথা উল্লেখ নেই। সাহাবা ও তাবেয়ীনগণের আমল দ্বারাও এ রাত উদযাপন বিষয়ে কোন কিছু প্রমাণিত হয় নি। তার উপর আমাদের সমাজে শবে বরাত বিষয়ে যে অলীক ধারণাসমূহ শিকড় গেড়ে আছে। এই লেখায় সেইসব বিষয়ের বর্ণনা ও যুক্তি সহকারে রেফারেন্সের সাথে তা মূলোৎপাটন করার চেষ্টায় নিবৃত্ত হয়েছি মাত্র। আল্লাহ্ আমাদের সকল ধরনের বিদ’আত থেকে দূরে থাকার তৌফিক দিয়ে দিন। আমিন।
শবে বরাত | সঠিক দৃষ্টিকোণ
শবে বরাত আভিধানিক অর্থ
‘শব’ ফারসি শব্দ। অর্থ রাত বা রজনী। বরাত শব্দটিও মূলে ফারসি। অর্থ ভাগ্য। দু’শব্দের একত্রে অর্থ হবে, ভাগ্য-রজনী। বরাত শব্দটি আরবি ভেবে অনেকেই ভুল করে থাকেন। কারণ ‘বরাত’ বলতে আরবি ভাষায় কোন শব্দ নেই। ‘বারায়াত’কে যদি আরবি শব্দ ধরা হয় তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সম্পর্কচ্ছেদ, পরোক্ষ অর্থে মুক্তি। যেমন কুর’আন মাজীদে সূরা বারায়াত রয়েছে যা সূরা তাওবা নামেও পরিচিত। ইরশাদ হয়েছেঃ
بَرَاءَةٌ مِّنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ إِلَى الَّذِينَ عَاهَدتُّم مِّنَ الْمُشْرِكِينَ [٩:١]
সম্পর্কচ্ছেদ করা হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পক্ষ থেকে সেই মুশরিকদের সাথে, যাদের সাথে তোমরা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলে। (সূরা তাওবা, ১)
এখানে বারায়াতের অর্থ হল সম্পর্ক ছিন্ন করা। ‘বারায়াত’ মুক্তি অর্থেও আল-কুর’আনে এসেছে যেমনঃ
أَكُفَّارُكُمْ خَيْرٌ مِّنْ أُولَٰئِكُمْ أَمْ لَكُم بَرَاءَةٌ فِي الزُّبُرِ [٥٤:٤٣]
তোমাদের মধ্যকার কাফেররা কি তাদের চাইতে শ্রেষ্ঠ ? না তোমাদের মুক্তির সনদপত্র রয়েছে কিতাবসমূহে? (সূরা কামার, ৪৩)
আর বারায়াত শব্দটি যদি ফার্সি শব্দ ধরা হয় তাহলে উহার অর্থ হবে সৌভাগ্য। অতএব শবে বরাত শব্দটার অর্থ দাঁড়ায় মুক্তির রজনী, সম্পর্ক ছিন্ন করার রজনী। অথবা সৌভাগ্যের রাত, যদি ‘বরাত’ শব্দটিকে ফার্সি শব্দ ধরা হয়। শবে বরাত শব্দটিকে যদি আরবিতে তর্জমা করতে চান তাহলে বলতে হবে ‘লাইলাতুল বারায়াত’।
এখানে বলে রাখা ভালো যে এমন অনেক শব্দ আছে যার রুপ বা উচ্চারন আরবিও ফার্সি ভাষায় একই রকম, কিন্তু অর্থ ভিন্ন। যেমন- ‘গোলাম’ শব্দটি উভয় ভাষায় একই রকম লিখা ও উচ্চারন করা হয়। আরবিতে অর্থ কিশোর আর ফার্সিতে দাস। সার কথা হল ‘বারায়াত’ শব্দটিকে আরবি শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সম্পর্কচ্ছেদ বা মুক্তি। আর ফার্সি শব্দ ধরা হলে উহার অর্থ সৌভাগ্য।
আল-কুর’আনে শবে বরাতের কোন উল্লেখ নেই
শবে বরাত বলুন আর লাইলাতুল বারায়াত বলুন কোন আকৃতিতে শব্দটি কুর’আন মাজিদে খুঁজে পাবেন না। সত্য কথাটাকে খুঁজে পাবেন না, সত্য কথাটাকে সহজভাবে সহজভাবে বলতে গেলে বলা যায় পবিত্র কুর’আন মাজিদে শবে বরাতের কোন আলোচনা নেই। সরাসরি তো দূরের কথা আকার ইংগিতেও নেই।
অনেককে দেখা যায় শবে বরাতের গুরুত্ব আলোচনা করতে যেয়ে সূরা দু’খানের প্রথম চারটি আয়াত পাঠ করেন। আয়াতসমূহ হলঃ
حم [٤٤:١] হা-মীম।
وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ [٤٤:٢] শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের।
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ [٤٤:٣] আমি একে নাযিল করেছি। এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী।
فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ [٤٤:٤] এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।
শবে বরাত পন্থী আলেম উলামারা এখানে বরকতময় রাত বলতে ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন। আমি এখানে স্পষ্টভাবেই বলব যে, যারা এখানে বরকতময় রাতের অর্থ ১৫ শাবানের রাতকে বুঝিয়ে থাকেন তারা এমন বড় ভুল করেন যা আল্লাহ্র কালাম বিকৃত করার মত অপরাধ। কারনঃ
(১) কুর’আন মাজিদের এই আয়াতের তাফসীর বা ব্যাখ্যা সূরা আল-কদর দ্বারা করা হয়। সেই সূরায় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ [٩٧:١] আমি একে নাযিল করেছি লাইলাতুল-কদরে।
وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ [٩٧:٢] লাইলাতুল-কদর সম্বন্ধে আপনি কি জানেন?
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِّنْ أَلْفِ شَهْرٍ [٩٧:٣] লাইলাতুল-কদর হল এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمْرٍ [٩٧:٤] এতে প্রত্যেক কাজের জন্যে ফেরেশতাগণ ও রূহ অবতীর্ণ হয় তাদের পালনকর্তার নির্দেশক্রমে।
سَلَامٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطْلَعِ الْفَجْرِ [٩٧:٥] এটা নিরাপত্তা, যা ফজরের উদয় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।
অতএব, বরকতময় রাত হল লাইলাতুল কদর। লাইলাতুল বারায়াত নয়। সূরা দুখানের প্রথম সাত আয়াতের ব্যাখ্যা হল এই সূরা আল-কদর। আর এ ধরনের ব্যাখ্যা অর্থাৎ আল-কুর’আনের এক আয়াতের ব্যাখ্যা অন্য আয়াত দ্বারা করা হল সর্বোত্তম ব্যাখ্যা।
(২) সূরা দুখানের লাইলাতুল মুবারাকের অর্থ যদি শবে বরাত হয় তাহলে এ আয়াতের অর্থ দাঁড়ায় আল কুর’আন শাবান মাসের শবে বরাতে নাজিল হয়েছে। অথচ আমরা সকলে জানি আল-কুর’আন নাজিল হয়েছে রামাজান মাসের লাইলাতুল কদরে। যেমন সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন বলেন
شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ রমযান মাসই হল সে মাস, যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন।
(৩) অধিকাংশ মুফাসসিরে কিরামের মত হল উক্ত আয়াতে বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। শুধু মাত্র তাবেয়ী ইকরামা (রহ.) এর একটা মত উল্লেখ করে বলা হয় যে, তিনি বলেছেন বরকতময় রাত বলতে শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতকেও বুঝানো যেতে পারে।
তিনি যদি এটা বলে থাকেন তাহলে এটা তার ব্যক্তিগত অভিমত। যা কুর’আন ও হাদিসের বিরোধী হওয়ার কারণে পরিত্যাজ্য। এ বরকতময় রাতের দ্বারা উদ্দেশ্য যদি শবে বরাত হয় তাহলে শবে কদর অর্থ নেওয়া চলবে না।
(৪) উক্ত আয়াতে বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা শবে বরাত করা হল তাফসীর বির-রায় (মনগড়া ব্যাখ্যা), আর বরকতময় রাতের ব্যাখ্যা লাইলাতুল কদর দ্বারা করা হল কুর’আন ও হাদিস সম্মত তাফসীর। সকলেই জানেন কুর’আন ও হাদিস সম্মত ব্যাখ্যার উপস্থিতিতে মনগড়া ব্যাখ্যা (তাফসীর বির-রায়) গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই।
(৫) সূরা দুখানের ৪ নং আয়াত ও সূরা কদরের ৪ নং আয়াত মিলিয়ে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায় যে, বরকতময় রাত বলতে লাইলাতুল কদরকেই বুঝানো হয়েছে। সাহাবী ইবনে আব্বাস (রাঃ), ইবনে কাসির, কুরতুবি প্রমুখ মুফাসসিরে কিরাম এ কথাই জোর দিয়ে বলেছেন এবং সূরা দুখানের ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র অর্থ শবে বরাত নেওয়াকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাফসীরে মায়ারেফুল কুরআন দ্রষ্টব্য)
ইমাম কুরতুবি (রহঃ) তাঁর তাফসীরে বলেছেনঃ “কোন কোন আলেমের রাতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা উদ্দেশ্য হল মধ্য শাবানের রাত (শবে বরাত)।
কিন্তু এটা একটা বাতিল ধারণা।” অতএব এ আয়াতে ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ এর অর্থ লাইলাতুল কদর। শাবান মাসের পনের তারিখ রাত নয়।
(৬) ইকরামা (রঃ) বরকতময় রজনীর যে ব্যাখ্যা শাবানের ১৫ তারিখ দ্বারা করেছেন তা ভুল হওয়া সত্ত্বেও প্রচার করতে হবে এমন কোন নিয়ম-কানুন নেই। বরং তা প্রত্যাখ্যান করাই হল হকের দাবী। তিনি যেমন ভুলের উর্ধে নন, তেমনি যারা তাঁর থেকে বর্ণনা করেছেন তারা ভুল শুনে থাকতে পারেন অথবা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বানোয়াট বর্ণনা দেওয়াও অসম্ভব নয়।
(৭) শবে বরাতের গুরুত্ব সূরা দুখানের উক্ত আয়াত উল্লেখ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে আকিদাহ বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, শবে বরাতে সৃষ্টিকুলের হায়াত-মাউত, রিজিক-দৌলত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। আর শবে বরাত উদযাপনকারীদের শতকরা ৯৯ জনের বেশি এ ধারণাই পোষণ করেন। তারা এর উপর ভিত্তি করে লাইলাতুল কদরের চেয়ে ১৫ শাবানের রাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়। অথচ কুর’আন ও হাদিসের আলোকে এ বিষয়গুলি লাইলাতুল কদরের সাথে সম্পর্কিত। তাই যারা শবে কদরের গুরুত্ব বুঝাতে উক্ত আয়াত উপস্থাপন করেন তারা মানুষকে সঠিক ইসলামী আকিদাহ থেকে দূরে সরানোর কাজে লিপ্ত, যদিও মনে –প্রাণে তারা তা ইচ্ছা করেন না।
(৮) ইমাম আবু বকর আল জাসসাস তাঁর আল-জামে লি আহকামিল কুর’আন তাফসীর গ্রন্থে লাইলাতুন মুবারাকাহ দ্বারা মধ্য শাবানের রাত উদ্দেশ্য করা ঠিক নয় বলে বিস্তারিত আলোচনা করার পর বলেনঃ
লাইলাতুল কদরের ৪ টি নাম রয়েছে, তা হলঃ লাইলাতুল কদর, লাইলাতুল মুবারাকাহ, লাইলাতুল বারাআত ও লাইলাতুস সিক।
(আল জামে লি আহকামিল কুরআন, সূরা আদ-দুখানের তাফসীর দ্রষ্টব্য)
লাইলাতুল বারাআত হল লাইলাতুল কদরের একটি নাম। শাবান মাসের ১৫ তারিখের রাতের নাম নয়। ইমাম শাওকানি (রহঃ) তাঁর তাফসীর ফতহুল কাদিরে একই কথাই লিখেছেন। (তাফসীর ফাতহুল কাদির: ইমাম শাওকানি দ্রষ্টব্য)
এ সকল বিষয় জেনে বুঝেও যারা ‘লাইলাতুল মুবারাকা’র অর্থ করবেন শবে বরাত, তারা সাধারণ মানুষের গোমরাহ করা এবং আল্লাহ্র কালামের অপব্যাখ্যা করার দায়িত্ব এড়াতে পারবেন না।
রিফারেন্স: Islam House , Quraneralo.com
রিফারেন্স: Islam House , Quraneralo.com
(চলবে)
No comments:
Post a Comment