Friday, January 24, 2014

ইলম ৩.১



                                         بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ

                        শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু


প্রারম্ভিকা:

 কবি, কবিতা এসবকে ইসলাম কি চোখে দেখে এর উপর কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল অনেকদিন ধরেই। সময়, সুযোগ হচ্ছিল না। আবার অথেনটিক উপাদানও খোঁজ করছিলাম, যেসব লেখায় ব্যবহার করলে সবাই বুঝবে, অন্তত ডাউট আসবে না আর। কেননা একবার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে সূরা আশ-শো’আরা’র কিছু আয়াত উল্লেখ করে কুর’আনে কবিদের নিয়ে কি বলেছে তা লিখেছিলাম। সেখানে অনেক কবি এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। আমি বুঝাতে চেয়েছিলাম বর্তমান প্রেক্ষাপট, কবিরা কবিতায় এখন কি লিখে? মানব প্রেম ছাড়া তো আমার আর কিছু চোখে পড়ে না। যারা বিরুদ্ধাচরণ করেছিল সবাইই প্রায় এধরনের কবিতা লিখে। এজন্য আঁতে ঘা লাগা স্বাভাবিক বৈকি। সমস্যা হল সবাই কুর’আনের তাফসির পড়ে, কিন্তু পড়ার পড়া পড়ে যায় গভীরভাবে চিন্তা করে না, বিশ্লেষণ করে না। এজন্য তারা তাদের সামনে উদাহরণ দেখেও বুঝে না। আমার শুভানুধ্যায়ীরা বেশ কিছুদিন ধরেই বলছিলেন- এ নিয়ে কিছু লিখো না কেন? আমি আমার এবিষয়ক অজ্ঞতার দরুন বেশ ভয় পাচ্ছিলাম লিখতে। কারণ যাই লিখছি, যদি ভুল হয়- এই হাত কাল হাশরের ময়দানে সাক্ষ্য দিবে। তাই বেশ ঘাঁটাঘাঁটি করার পর, চিন্তা করার পর লেখার সামগ্রী মিলেছে বলেই লিখতে বসলাম।


প্রথমেই আসি, কুর’আনের একটি সূরার নাম নিয়ে। ২৬ নং সূরা। সূরা আশ-শো’আরা। এর মানে হল ‘কবিগণ’ [ The Poets ]। এই সূরার শেষের দিকের বেশ কিছু তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত নিয়েই জত জল্পনা-কল্পনা, ভুল বুঝাবুঝি, আলোচনা-সমালোচনা।

সুরাটির পটভূমি মক্কার মানুষদের রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সত্যপ্রচারের পরেও তা ক্রমাগত অস্বীকার করে যাওয়াকে ঘিরে। মাঝামাঝে তারা এমনও বলত যে যদি তারা নিদর্শন দেখতে পায়, তাহলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যে একজন নবী তা মেনে নিবে, মাঝেমাঝে তারা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কে কবি, জাদুকরের সাথে তুলনা করত এবং তাঁর প্রচারিত সত্যকে ব্যঙ্গ করত। মাঝেমাঝে তারা এও বলত যে ইসলাম গ্রহন করেছে গরীব, দাসেরা, যদি ধনী এবং অভিজাতেরা ইসলাম গ্রহন করত তাহলে সেটা মর্যাদা পেত- এইসব বলে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর ধর্মপ্রচারে বাধা দিত।

সুরাটির শুরু থেকে ১৯১ নং আয়াত পর্যন্ত প্রায় একই ধরনের কথাই বলা হয়েছে।

 “পুরো পৃথিবী জুড়েই অসংখ্য নিদর্শন আছে, কেবল সত্যান্বেষীরাই একমাত্র তার সন্ধান পায়। কিন্তু বিপথে চলে যাওয়া মানুষেরা এসব নিদর্শন দেখেও বুঝে না- ভাবে এসব নবীদের কেরামতি অথবা প্রাকৃতিক কোন ঘটনা। বুদ্ধিমান মানুষেরা এসব নিদর্শন দেখা মাত্রই বুঝে ফেলে এবং বিচার করতে পারে নবীদের সত্যপ্রচারের সাথে। যুগে যুগে অসংখ্য নবী এসেছেন সত্যপ্রচারের নিমিত্তে। সব নবীদের সময়েই মানুষ কথা শুনেনি, গালমন্দ করেছে, বিপথে গিয়েছে। মুসা (আঃ)এর সময়ে ফেরাউন, নুহ (আঃ) এর সম্প্রদায়, সালিহ (আঃ) এর সম্প্রদায়, আদ-সামুদ জাতি, লুত (আঃ) এর সম্প্রদায় ভালকরেই আল্লাহ্‌ প্রদত্ত নিদর্শন দেখেছে, তারপরেও তারা অস্বীকার করেছে। নবী (আঃ) দের কবি/ জাদুকর বলে সাব্যস্ত করেছে। শুধু যে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর সময়ে এসব হয়েছে তা নয়, আগেও অবিশ্বাসীরা আল্লাহ্‌র দূত নবী (আঃ)দের সাথে বিরূপ ব্যবহার করেছে। অবিশ্বাসীদের মানসিকতা যুগে যুগে একইরকমই ছিল। একটা জাতি যখন পাপের অন্ধকারে ডুবে যেত তখন আল্লাহ্‌ আলোকবর্তিকারুপে পাঠাতেন নবী-রাসুলদের, তাঁদের চরিত্র, ব্যবহার, প্রচারিত সত্য যুগে যুগে একইরকম ছিল।

Lastly, the discussion has been summed up, saying "O disbelievers, if at all you want to see the Signs, why should you insist on seeing those horrible Signs that visited the doomed communities of the past? Why don't you see the Qur'an which is being presented in your own language? Why don't you see Muhammad (upon whom be Allah's peace and mercy) and his Companions? Can the revelations of the Qur'an be the work of a satan or a jinn? Does the recipient of the Qur'an appear to be a sorcerer? Are Muhammad and his Companions no different from a poet and his admirers? Why don't you give up disbelief and search your hearts for their judgment? When in the heart of your hearts you yourselves believe that the Revelations of the Qur'an have nothing in common with sorcery and poetry, then you should know that you are being cruel and unjust, and will certainly meet the doom meant for the cruel and unjust."

এতক্ষন সুরাটির পটভূমি নিয়ে আলোচনা করলাম, এইবার চলুন আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে যাই। আমাদের আলোচনা শুরু হয়েছে ২২১ নং আয়াত থেকে, চলুন দেখি আল্লাহ্‌ কি বলেছেন-

২২১)  هَلْ أُنَبِّئُكُمْ عَلَىٰ مَن تَنَزَّلُ الشَّيَاطِينُ
আমি আপনাকে বলব কি কার নিকট শয়তানরা অবতরণ করে?

২২২) تَنَزَّلُ عَلَىٰ كُلِّ أَفَّاكٍ أَثِيمٍ
তারা অবতীর্ণ হয় প্রত্যেক মিথ্যাবাদী, গোনাহগারের উপর।

২২৩) يُلْقُونَ السَّمْعَ وَأَكْثَرُهُمْ كَاذِبُونَ
তারা শ্রুত কথা এনে দেয় এবং তাদের অধিকাংশই মিথ্যাবাদী।

২২৪) وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ
বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে।

২২৫) أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ
তুমি কি দেখ না যে, তারা প্রতি ময়দানেই উদভ্রান্ত হয়ে ফিরে?

২২৬) وَأَنَّهُمْ يَقُولُونَ مَا لَا يَفْعَلُونَ
এবং এমন কথা বলে, যা তারা করে না।

২২৭) إِلَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَذَكَرُوا اللَّهَ كَثِيرًا وَانتَصَرُوا مِن بَعْدِ مَا ظُلِمُوا ۗ وَسَيَعْلَمُ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَيَّ مُنقَلَبٍ يَنقَلِبُونَ
তবে তাদের কথা ভিন্ন, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং আল্লাহ কে খুব স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে। নিপীড়নকারীরা শীঘ্রই জানতে পারবে তাদের গন্তব্যস্থল কিরূপ।

আমাদের সামগ্রিক আলোচনা এই ৮টি আয়াতকে ঘিরেই।




আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়

কবিতার সংজ্ঞা:  তাফসিরকারকদের অভিধান অনুযায়ী এমন বাক্যাবলিকে কবিতা বলা হয়, যাতে শুধু কাল্পনিক ও অবাস্তব বিষয়বস্তু বর্ণিত হয়। এর জন্য ছন্দ, ওজন এবং সমিল শব্দ ইত্যাদিও শর্ত নয়। তর্কশাস্ত্রেও এ ধরনের বিষয়বস্তুকে ‘কবিতাধর্মী প্রমাণ’ এবং কবিতা-দাবীযুক্ত বাক্য বলা হয়। পারিভাষিক কবিতা ও গজলেও সাধারণত কাল্পনিক বিষয়াদির প্রাধান্য থাকে। তাই কবিদের ভাষায় ছন্দযুক্ত সমিল শব্দযুক্ত বাক্যাবলীকে কবিতা বলা হয়ে থাকে। কোন কোন  তাফসীরকারক কুর’আনের আয়াতে পারিভাষিক কবিতার অর্থ ধরে বলেছেন যে, মক্কার কাফেররা রাসুলুল্লাহ(সাঃ)-কে ওজন ও সমিল শব্দধারী বাক্যাবলী নিয়ে আগমনকারী বলত। কিন্তু কেউ কেউ বলেছেন যে, কাফেরদের উদ্দেশ্য এটা ছিল না। কারণ, তারা কবিতার রীতি-নীতি সম্বন্ধ্যে সম্যক জ্ঞাত ছিল। বলাবাহুল্য, কুর’আন কবিতাবলীর সমষ্টি নয়।
একজন অনারব ব্যক্তিও এধরনের কথা বলতে পারে না প্রাঞ্জল ও বিশুদ্ধভাষী আরবরা বলা দূরের কথা; বরং কাফেররা তাঁকে আসল ও আভিধানিক অর্থে কবি অর্থাৎ, কাল্পনিক বিষয়াদি নিয়ে আগমনকারী বলত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে (নাউজুবিল্লাহ) মিথ্যাবাদী বলা। কারণ, شُّعَرَ (কবিতা) মিথ্যার অর্থেই ব্যবহৃত হয় এবং كَاذِبُونَ তথা মিথ্যাবাদীকে الشُّعَرَاءُ বলা হয়। তাই প্রমাণাদিকে কবিতাধর্মী প্রমাণাদি বলা হয়ে থাকে। মোটকথা এই যে, ছন্দযুক্ত ও সমিল শব্দযুক্ত বাক্যবলীকে যেমন কবিতা বলা হয়, তেমনি ধারণাপ্রসূত আনুমানিক বাক্যাবলীকেও কবিতা বলা হয়। এটা তর্কশাস্ত্রের পরিভাষা।
وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ আলোচ্য আয়াতে কবিতার পারিভাষিক ও প্রসিদ্ধ অর্থই বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যারা ওজনধারী ও সমিল শব্দযুক্ত বাক্যাবলী রচনা করে, আয়াতে তাদের সমালোচনা করা হয়েছে। ফতহুল-বারীর এক রেওয়াত থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। রেওয়াত এই যে, এই আয়াত নাযিল হবার পর হযরত আবদুল্লাহ ইবনে রাওয়াহা, হাসনান ইবনে সাবেত, কা’ব ইবনে মালেক প্রমুখ সাহাবী কবি ক্রন্দনরত অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সাঃ)-এর খেদমতে উপস্থিত হন এবং আরজ করেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ, আল্লাহ্‌ তা’আলা এই আয়াত নাযিল করেছেন। আমরাও তো কবিতা রচনা করি এখন আমাদের কি উপায়?” রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “আয়াতের শেষাংশ পাঠ কর। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, তোমাদের কবিতা যেন অনর্থক ও ভ্রান্ত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়। কাজেই তোমরা আয়াতের শেষাংশে উল্লেখিত ব্যতিক্রমীদের শামিল।” এর পরিপ্রেক্ষিতে তাফসীরকারগণ বলেছেন, “আয়াতের প্রথমাংশে মুশরিক কবিদের বোঝানো হয়েছে। কেননা, পথভ্রষ্ট লোক, অবাধ্য শয়তান ও উদ্ধত জিন তাদেরই কবিতা অনুসরণ করত এবং তা বর্ণনা করত।” (ফতহুল-বারী)

আজ এই পর্যন্তই। পরবর্তী পর্বে ইসলামী শরীয়তে কাব্যচর্চার মান, বর্তমান যুগে কবিতা চর্চা ও যুবসমাজের উপর তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব ইনশা আল্লাহ্‌।

যেখান থেকে সাহায্য নিয়েছি: তাফসীরে মা’রেফুল কুর’আন, জিকর সফটওয়্যার, তাফসীর ইবনে কাসির, তাফসীর ফি জিলালিল কুর’আন।       

(চলবে)         
                    

                               

Friday, January 10, 2014

কুর’আনের বাংলা অনুবাদকে বাংলা কুর’আন বলা জায়েয নয়

আরবীর মূল বাক্যাবলী ছাড়া শুধু কুর’আনের অনুবাদ কোন ভাষায় লেখা হলে তাকে সেই ভাষার কুর’আন বলা জায়েয নয়; যেমন আজকাল অনেকেই শুধু বাংলা অনুবাদকে ‘বাংলা কুর’আন’ ইংরেজি অনুবাদকে ‘ইংরেজি কুর’আন’ বলে থাকে। এটা না জায়েয ও ধৃষ্টতা। মূল বাক্যাবলী ছাড়া কুর’আনকে অন্য ভাষায় ‘কুর’আন’ নামে প্রকাশ করা এবং তা ক্রয়-বিক্রয় করা না-জায়েয।  
        

তথ্যসূত্র:  তফসীর মাআরেফুল কুর’আন | সূরা আশ-শো’আরা, পৃষ্ঠা নং-৯৮৫