بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু
সকালবেলা। অফিসপাড়া তখনো ব্যস্ত হয়ে উঠেনি। খাবারের গাড়িটা মাত্রই
এসেছে। একটা লোক দরজাটা খুলে বের করছে বিস্কুটের প্যাকেট, বাটার বন,
হানি কম্ব নানান টাইপের খাবারগুলো। দোকানের বুড়ো চাচা বুঝে
নিচ্ছেন প্রোডাক্টগুলো। খুশিমনে চাচা সুন্দর করে তার ছোট্ট টঙ্গে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন
খাবারগুলো। নতুন দিনের নতুন খাবার।
দূর থেকে এসব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে চেয়ে দেখছিল একটি কিশোর। পরনে
ছেড়া সাদা গেঞ্জি,
একটি থ্রি-কোয়ার্টার। তার সামনে একটা ঠ্যালাগাড়ি। সেথায় টুপি পড়া
দাড়িওয়ালা এক বৃদ্ধ। সামনে একটা থালা। ওতে ছড়ানো ছিটানো কিছু দুই টাকা আর নাম না
জানা কয়েন। কিছুক্ষণ দোকানের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার শুরু করল আকুতি-মিনতি। গতকাল
থেকে কিছু খেতে পায়নি তার অন্ধ বাবা। কিছু টাকা দরকার।
আজকে রাস্তাটা ফ্রিই ছিল। এখানে আসতে লেগেছে মাত্র ১০ মিনিট। এখনো
অফিস খুলেনি। অগত্যা বসে আছি চায়ের দোকানে। ধূমায়িত রং চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে ডুবিয়ে
খাচ্ছি আর সময় কাটাচ্ছি। একটা প্লট মাথায় এসেছে। ঠিক করেছি, ওয়ার্ডে
একটা খসড়া লিখে ফেলব। খাবারের গাড়িটা মাত্রই এসেছে। বাতেন চাচা লতিফ মিয়ার কাছ
থেকে প্রোডাক্টগুলো বুঝে নিয়ে খুশি মনে দোকান সাজাচ্ছিল। হানি কম্ব আমার খুব
প্রিয়। মাথায় কিছু প্ল্যান করে ফেললাম। কয়েকটা কিনতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি
হয়ে গেলাম সদা হাস্যজ্জ্বল বাতেন চাচার নতুন দিনের প্রথম কাস্টমার।
একটা প্যাকেট খুলে ফেলেছি। এই হানি কম্ব আমার কাছে এক জান্নাতের
খাবার। লাঞ্চের জন্য একটা, আর বাকিটা রাত্রে খাব বলে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম।
সাড়ে আটটা বেজে গেছে। হানি চিবুতে চিবুতে অফিসের নিচে চলে এসেছি। অফিসের দারোয়ান
মফিজ মিয়া হাসিমুখ করে বলল, স্লামালাইকুম স্যার। ঠিক তখনই
একটি করুন আকুতি আমার কর্ণকুহুরে প্রবেশ করল। পিছনে ফিরে দেখলাম একটি কিশোর,
সামনে এক বৃদ্ধকে ঠেলছে। রাত হতে কিছু খায়নি। টাকার দরকার।
মানিব্যাগ হাতড়ালাম। ২০ টাকা পাওয়া গেল। নাহ এটা দেয়া যাবে না। স্যালারি হয়নি
এখনো। সন্ধ্যায় এটা দিয়েই বাড়ি ফিরতে হবে।
কিশোর আমার দিকে চেয়ে আছে। কান্নামাখা চাহুনি। আমার হাতে সদ্য শেষ
সাবাড় করা দুমড়ানো মুচড়ানো হানি কম্বের প্যাকেট। হঠাৎ করেই ব্যাগে হাত চলে গেল
আমার। হানি কম্বের দুইটা প্যাকেট বের হয়ে আসলো। কিছু না ভেবেই ধরিয়ে দিলাম কিশোরের
হাতে। কিশোর চমকে গেছে। তার মুখে কোন কথা নাই। আমিও জানি না এটা কি হল! ঘুরে
দাঁড়িয়ে অফিসের সিঁড়ি দিয়ে উঠা শুরু করলাম। মনে আমার প্রবল ঝড় বইছে। চিন্তার ঝড়।
এটা কি হল! পেছনে ফিরে তাকালাম। এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে কিশোর। পরনে ছেড়া সাদা
গেঞ্জি, একটি থ্রি-কোয়ার্টার। তার সামনে একটা ঠ্যালাগাড়িতে তার অন্ধ ভাবা।
কিশোরের চোখে একরাশ কৃতজ্ঞতা। মুখে এক চিলতে হাসি।
আমরা আমাদের জীবনে প্ল্যান করে রাখি এক। হয় আরেক। ঘটনার আকস্মিকতায়
আমিই চমকে গিয়েছি। বাতেন চাচার দোকানে ঝুলে থাকা হানি কম্বগুলো আমারই হওয়ার কথা
ছিল। কিন্তু আল্লাহ সবচেয়ে বড় পরিকল্পনাকারী। কিশোর কস্মিনকালেও ভাবেনি যে সে ঝুলে
থাকা হানি কম্ব সে পাবে। হয়তোবা সে মনের মাঝে ভেবেছে। আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ
জানিয়েছে। আল্লাহ তার বান্দাকে নিরাশ করেননি। আমি আমার তাকদিরে লেখা অংশটুকু পেয়ে
গিয়েছি। নিশ্চয়ই আল্লাহ যা করেন আমাদের মঙ্গলের জন্যই করেন।
আমি যতবার দূর-দুরান্তে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেরিয়েছি, আমার মনে
হয়েছে আল্লাহ হলেন আর-রাযযাক। কীসের যোগ্যতা, কীসের কর্ম,
কীসের বংশ আর কীসের মাপকাঠি, আল্লাহ
সবাইকেই তার রিযিক দান করেন। আল্লাহ হয়ত বিভিন্ন উপায়ে রিযিক দেন আমাদের-- কিন্তু
রিযিক বন্টনের কাজটির মালিক কেবলই তিনি। সমস্ত মানুষ, প্রাণী,
উদ্ভিদ, পোকামাকড় সবাই আল্লাহর নিপুণ
রিযিক বন্টন থেকেই পায়।
এদিকে মুমিনের জন্য তাকওয়া থাকলেই রিযিক দেয়ার নিশ্চয়তা আল্লাহ
দিয়েছেন। বুঝিনা আমরা। অবশ্যই বেখবর। নইলে সহজ পথ ছেড়ে কি আর কঠিনে ডুবি?
No comments:
Post a Comment