بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।
প্রথম প্রথম যখন লেখাপড়া শুরু করি, তখন বিভিন্ন বিষয়ে আমার খটকা লেগেইছিল। তার একটি হল তাকদির। বিষয়টা হল, আমি অতিরিক্ত গভীরভাবে চিন্তা করতে গিয়ে সিম্পল একটা ব্যাপার লেজেগোবরে করে ফেলতাম। আলহামদুলিল্লাহ্, এখন তাকদিরের কনসেপ্ট আমার ক্লিয়ার। ক্লিয়ারের জন্য অনেক বই পড়েছি। সিনিয়র, ব্যাচমেট বন্ধুরা সাহায্য করেছে ব্যাপারটা সিম্পলি চিন্তা করতে।
আরেকটা যে জিনিস ছিল তা হল এমন- আমি প্রায়ই ভাবতাম আল্লাহ্ তো সবই জানেন আমার ভাগ্যে কি আছে, সব লেখা আছে। তাহলে শুধু শুধু এখানে এলাম কেন?! আল্লাহ্ তো জানেনই আমি জান্নাতে যাব নাকি জাহান্নামে যাব। তাহলে কেন পৃথিবীতে এলাম? দুই জায়গার যেকোনো জায়গায় তো যেতে পারতাম। আমার চিরচারিত অভ্যেস- গভীর ভাবে চিন্তা করা। লেগে গেলাম এটা নিয়ে। বই পড়তে থাকলাম। আবছা আবছা উত্তর মিলে। কিন্তু আমার চাই যুক্তিসঙ্গত উত্তর, যা পড়ে আমি শান্তি পাব। আশা করি এধরনের প্রশ্ন আমার মত অনেকেরই মাথায় এসেছে। উত্তর আমার মিলেছে।
চলুন এ নিয়ে কিছুক্ষন আলোচনা করা যাক। এবিষয়ে লিখতে গিয়ে আমি সাহায্য নিয়েছি- ডঃ আবু আমিনাহ বিলাল ফিলিপস রচিত "স্রষ্টা ধর্ম জীবন" বইটির।
মহান আল্লাহ্ তা'আলা সুবিচারক ও ন্যায়পরায়ণ। শেষ বিচারের দিন তাঁর অজস্র গুনের মত এই গুণগুলো প্রতিভাত হবে। আল্লাহ্ চাইলেই কিন্তু আমাদেরকে সৃষ্টির পরেই তাঁর অসীম জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে জান্নাত কিংবা জাহান্নামে পাঠিয়ে দিতে পারতেন, পৃথিবীতে না পাঠিয়েই। কারণ আল্লাহ্ তো একটা মানুষকে সৃষ্টির আগে থেকেই জানতেন- সে জীবনে কি কি সিদ্ধান্ত নিবে।
যারা জান্নাতে যাবার যোগ্য শুরুতেই তাদেরকে আল্লাহ্ জান্নাতে পাঠিয়ে দিতেন। তারা আরাম-আয়েশে সেখানে জীবন-যাপন করত। তারা আল্লাহ্র এমন সিদ্ধান্তে কোনরূপ প্রশ্নই তুলত না বরঞ্চ জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য আল্লাহ্র প্রতি কৃতজ্ঞ থাকত।
অপরদিকে, যারা সরাসরি জাহান্নামে যেত, তারা অবশ্য এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলত। পৃথিবীতে পাঠানো হলে তারা কি করত সেটা না জানার কারনে তারা তর্ক জুড়ে দিত, মনে হতো যে তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে, সেই সাথে বলত যে পৃথিবীতে জীবনযাপনের সুযোগ দিলে তারা ইসলামের প্রতি বিশ্বাস করত আর ভালো কাজ করত।
আর এসব কারনেই আল্লাহ্ আমাদেরকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন এবং আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো নিতাম সেগুলো নেবার সুযোগ করে দিয়েছেন। এর ফলে যারা যারা জাহান্নামে প্রবেশ করবে তারা পরবর্তীতে বুঝবে যে তারা তাদের কাজের ফলেই সেখানে গিয়েছে। তারাই জাহান্নামকে আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে। তখন তারা নিজের জীবনে আল্লাহ্র অনুগ্রহসমুহকে উপলব্ধি করতে পারবে, তারা যে দুনিয়ায় আল্লাহ্র অজস্র নেয়ামতের মধ্যে ডুবে থেকেও সেসব অস্বীকার করেছে, পাপকর্ম করেছে সেসমস্ত স্বীকার করতে বাধ্য হবে। ফলে সর্বশেষে আল্লাহ্র বিচারকে ত্রুটিহীন এবং ন্যায়নিষ্ঠ বলে স্বীকার করে নিবে। তবে এরপরেও তারা আরেকটিবারের জন্য পৃথিবীতে ফিরে এসে ভালো কাজ করার জন্য সুযোগ প্রার্থনা করবে।
আল্লাহ্ সুবহানাল্লাহ্ তা'আলা কুর'আনে বলেছেন-
যদি আপনি দেখতেন যখন অপরাধীরা তাদের পালনকর্তার সামনে নতশির হয়ে বলবে, হে আমাদের পালনকর্তা, আমরা দেখলাম ও শ্রবণ করলাম। এখন আমাদেরকে পাঠিয়ে দিন, আমরা সৎকর্ম করব। আমরা দৃঢ়বিশ্বাসী হয়ে গেছি। (সূরা আস-সাজদা, আয়াত ১২)
কিন্তু ব্যাপারটা হল, যে জাহান্নামে শাস্তি পেয়েছে আল্লাহ্ যদি তা ভুলিয়ে আবার তাকে পৃথিবীতে ফেরত পাঠাতেন, তাহলে তারা আবার খারাপ কাজ করে আবারও জাহান্নামের জন্যই উপযুক্ত হত। এই বিষয়ে আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেন-
এবং তারা ইতি পূর্বে যা গোপন করত, তা তাদের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। যদি তারা পুনঃ প্রেরিত হয়, তবুও তাই করবে, যা তাদেরকে নিষেধ করা হয়েছিল। নিশ্চয় তারা মিথ্যাবাদী। (সূরা আল-আন'আম, আয়াত ২৮)
বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী যাই বলুন না কেন- এই যে আমাদের সবাইকেই এই সুন্দর পৃথিবীতে আল্লাহ্র অজস্র নেয়ামতের মধ্যে বসবাসের সুযোগ দেয়া হয়েছে- আমরা কি বুঝি না আল্লাহ্ তা'আলা আমাদেরকে কত ভালোবাসেন। যারা দুনিয়ায় মন্দকে বাদ দিয়ে ভালোকে বেছে নিবে তাদের জন্য আল্লাহ্ তা'আলা জান্নাত সৃষ্টি করেছেন। এই নিদর্শনের মাঝেই আল্লাহ্র ভালোবাসা উদ্ভাসিত হয়।
তবে যারা সত্য সত্যই তাদের পাপকর্মের জন্য আল্লাহ্র কাছে করজোড়ে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চায়, তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার আগ্রহের মাঝেই যেন আল্লাহ্র ভালোবাসা বিশেষভাবে প্রকাশ পায়। আমাদের পাপ মোচনের জন্য তাওবার দরজা খুলে রাখা হয়েছে। গুনাহ যতই বড় হোক না কেন, পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত আল্লাহ্র কাছে তাওবা করার সুযোগ মিলবে।
আল্লাহ্ তা'আলা নবী কারীম (সাঃ)-কে বিশ্বাসীদের উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো বলার নির্দেশ দিয়েছেন-
বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহ ও তোমাদিগকে ভালবাসেন এবং তোমাদিগকে তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেন। আর আল্লাহ হলেন ক্ষমাকারী দয়ালু। (সূরা আলে-ইমরান, আয়াত ৩১)
আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ্র রাসুল (সাঃ) বলেছেন-
'সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ বলেছেন, "হে আদমসন্তান, তুমি যতক্ষন পর্যন্ত আমাকে ডাকবে এবং আমার কাছে চাইবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তোমাকে তোমার কৃতকর্মের জন্য মাফ করে দিতে থাকব এবং আমি কোন কিছুর পরোয়া করি না। হে আদমসন্তান, তোমার পাপ যদি আকাশ ছুঁয়ে ফেলে আর তারপর তুমি আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, আমি তোমাকে মাফ করে দিব। হে আদমসন্তান, তুমি যদি আমার সাথে কাউকে শরিক না করে পৃথিবী-ভরা পাপ নিয়েও আমার কাছে আসো তবে আমিও তেমন বিশাল ক্ষমাশীলতা নিয়ে তোমার সাথে সাক্ষাত করব।''' (সহীহ সুনান আত-তিরমিজি, নম্বর ২৮০৫)
আমার কিছু বন্ধুদের জীবনে প্রায়শই হতাশাঘেরা কথাবার্তা বলতে শুনেছি। তারা অনেক পাপকর্ম করে ফেলেছে। হা-হুতাশ করছে এনিয়ে। আল্লাহ্ কি তাদের মাফ করবেন। উপরের হাদিস থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে, এক শিরক ছাড়া আল্লাহ্ তা'আলা সব কিছু ক্ষমা করে দিবেন। বান্দা যদি আকাশ পরিমাণ পাপকর্মও করে তাহলেও।
প্রকৃতঅর্থে আমরা অনেকেই কুর'আন আর হাদিস থেকে ইলম অর্জন করি না। আল্লাহ্ তা'আলা যে কি পরিমাণ নেয়ামত আমাদের চারপাশে দিয়ে রেখেছেন তা আমরা কিকরে বুঝব যদি আমরা কুর'আন, হাদিস না পড়ি। এজন্যই চারপাশ থেকে হতাশাব্যাঞ্জক "আমি কি মাফ পাব?!" কথাগুলো শুনতে হয়।
এজন্যই যারা পড়ে না, যারা চিন্তা করে না আমার মনে হয় তারা অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয়। দুনিয়া দুইদিনের। সবাই দুনিয়াবি ইলম অর্জনে ব্যস্ত, কেউই দ্বীনী ইলমের ধার ধারে না। তাদের জন্যই আমার এসব লেখা। এসব পড়ে যেন তারা উদ্বুদ্ধ হয়- কুর'আন-হাদিসে কি যে কি পরিমান ইলম আছে সেটা তাদের বুঝানো। এজন্যই এতসব লিখালিখি। আমার উদ্দেশ্য এটাই যে, নিজে ইলম অর্জন করব , আর সেই ইলমের উপর ভিত্তি করে লেখা লিখব সহজ ভাষায়, যাতে করে বিষয়টা সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। আর মানুষ বেশি বেশি করে আল্লাহ্র পথে, এই ইসলামের পথে ফিরে আসে, ইলম অর্জন করে।
মহান আল্লাহ্ তা'আলা সবার আশা-আকাঙ্খা পূরণ করুন। সবাইকে সৎ- সঠিক পথে চলার জন্য তৌফিক দান করুন। আমিন।
জাজাকআল্লাহ্ খাইরান।
ফেইসবুক নোটস লিঙ্ক
৩০ ডিসেম্বর, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ