بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ
শুরু করছি আল্লাহর নামে যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু
অনেকেই
প্রশ্ন করেন, “কোনো
‘আলিম—যিনি অনেক জানেন, কিন্তু তার মধ্যে হয়তো সেই পরিমাণ
চর্চা নেই—সে কী করছে না করছে এত কিছু না-ভেবে শুধু দীন শেখার উদ্দেশ্যে তাঁর কাছে
গেলে ক্ষতি কী?”
আপাতদৃষ্টিতে
প্রশ্নটি যুক্তিসঙ্গত মনে হলেও, নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন তো, “আমি কি
এমন কারও কাছ থেকে বিমান ওড়ানো শিখব, যে কিনা বিমান
সম্বন্ধে সবকিছুই জানে, অথচ কখনো কোনো বিমান ওড়ায়নি?”
আসলে
সমস্যাটা হচ্ছে ইসলামের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে। ইসলাম কোনো মতবাদ বা
কারও ব্যক্তিগত ভাবাদর্শ নয়। ইসলামের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হয়েছে একে মতবাদের স্তরে
নামিয়ে এনে। আর দশটা মতবাদ আর দর্শন যেভাবে শিখি ইসলামকেও আজ আমরা সেভাবে শিখছি।
আমরা ইসলামের মূলনীতিগুলো শিখি, আইনের জটিল খুঁটিনাটি বিষয়গুলো শিখি, এটা ওটার
মানে শিখি―কিন্তু যা শিখেছি সেটা চর্চা করার কোনো প্রয়োজন দেখি
না। এটাই কি পূর্বসূরি-সালাফদের নীতি?
আপনারা
অনেকেই ইব্ন ‘উমার (রা.)-এর সেই ঘটনাটার সাথে পরিচিত। সেখানে আমরা দেখি, সবকিছুর ওপরে তাঁরা চর্চা বা
‘আমাল করাকে গুরুত্ব দিতেন। যা শিখেছেন সেটার চর্চা করে সন্তুষ্ট না-হওয়া পর্যন্ত
তাঁরা ইচ্ছে করেই আর নতুন কিছু শিখতেন না। কত সুন্দর করেই না আমরা মানুষদের এ
ঘটনাগুলো বলে বেড়াই কিন্তু আমাদের মধ্যে সেই চর্চা কোথায়? এটা কেমন মানসিকতা?
ইসলাম
একটি জীবন ব্যবস্থা। নৈতিক মূল্যবোধের বাস্তব প্রতিচ্ছবি। চর্চা ও আচার-আচরণের মাধ্যমে
ইসলামের প্রকৃত চিত্র ফুটে ওঠে। পরিপূর্ণভাবে ইসলাম চর্চা করছেন এমন কাউকে সরাসরি
দেখে ও তাঁর সাথে থেকে ইসলাম যতটা শেখা যায়, কেবল বই পড়ে কিংবা কিছু লেকচার শুনে তার
সামান্যই শেখা যায়। সাহাবাদের মর্যাদা কেন এত উঁচুতে? কারণ
তাঁরা পেয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গ। তাঁর সাথে থেকে থেকে ইসলামের পাঠ
নিয়েছেন সাহাবারা। নিজেদেরকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে এভাবেই শিক্ষা দিতেন
পূর্বসূরি বিদ্বানগণ।
সুতরাং
একজন দীন-শিক্ষার্থীর জন্য প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে তার
শিক্ষকের যোগ্যতা বিবেচনা করা। আমার মতে একজন শিক্ষকের মধ্যে নিম্নলিখিত পাঁচটি
গুণ খুঁজে দেখতে হবে। এবং যার মধ্যে এই গুণগুলো পাওয়া যাবে তাকেই গ্রহণ করতে হবে।
খেয়াল রাখতে হবে এই সবগুলো গুণেরই চিহ্ন যেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের কথায়, কাজে ও জীবনে চোখে পড়ে।
কোনটার প্রাধান্য বেশি হবে সেই ভিত্তিতে এগুলো এভাবে সাজানো হয়েছে:
- · শিক্ষকের তাকওয়া (আল্লাহর প্রতি সদা-সচেতনতা) ও খাশিয়াতুল্লাহ (আল্লাহভীতি—তাঁর যুহ্দ ও ইবাদাহ, বিশেষ করে নাওয়াফিল ইবাদাহ)
- · তাঁর আকীদাহ (তাওহীদের বিশুদ্ধতা; শির্ক ও কুফ্রের প্রতি প্রবল ঘৃণা)
- · সুন্নাহর অনুসরণ (প্রাত্যহিক সব কাজে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে)
- · নাম-খ্যাতি-সম্পদের মোহ এড়িয়ে চলা (কারণ এগুলো হৃদয়ের অসুখ)
- · জ্ঞান
এখানে
লক্ষ্যণীয় যে, জ্ঞানকে
আমি সবার শেষে স্থান দিয়েছি। জ্ঞানের গুরুত্ব নেই, ব্যাপারটা
এমন না; তবে অন্যান্য গুণাবলির তুলনায় এটাই এর প্রকৃত
অবস্থান। যে-জ্ঞানীর মধ্যে তাকওয়া ও খাশিয়াতুল্লাহর অভাব রয়েছে, তাঁর আকীদা-বিশ্বাস ভ্রান্ত, সে সুন্নাহর
অনুসরণ করে না, সে ছোটে অর্থহীন খ্যাতি ও সম্পদের পেছনে।
যেই জ্ঞান তার নিজেরই কোনো কাজে লাগেনি, সেই জ্ঞান দিয়ে
সে কীভাবে তার ছাত্রদের কল্যাণ করবে?
আল-বিশ্র
আল-হাফি নামে ইমাম আহমাদ ইব্ন হানবালের একজন বন্ধু ছিলেন। ইমাম আহমাদ তাঁর
বন্ধুকে উস্তাদ বলতেন। কেউ একজন তাঁকে বললেন, ‘বিশ্র তো খুব বেশি হাদীস় জানে না; তার ইল্ম কম।’ ইমাম আহমাদ বললেন, “জ্ঞানের
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে খাশিয়াতুল্লাহ। বিশ্রের আল্লাহভীতি প্রবল।
প্রকৃত ইল্ম এটাই।”
ইমাম
মালিকের উস্তাদের ব্যাপারে তাঁর মা তাঁকে উপদেশ দিতেন, “রাবী’ঈয়ার কাছ থেকে জ্ঞান
শেখার আগে আখলাক় শিখবে।”
‘উলামার
গুণাবলী বর্ণনায় আল্লাহ বলেছেন,
ফাতির ২৮: إِنَّمَا
يَخْشَى اللَّهَ
مِنْ عِبَادِهِ
الْعُلَمَاء
(অর্থের
ব্যাখ্যা) যাদের মধ্যে জ্ঞান আছে আল্লাহর দাসদের মধ্যে তারাই প্রকৃত অর্থে তাঁকে
ভয় করে।
তিনি
আরও বলেছেন,
হুজুরাত ১৩: إِنَّ
أَكْرَمَكُمْ عِندَ
اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
(অর্থের
ব্যাখ্যা) তোমাদের মধ্যে যার তাকওয়া আছে আল্লাহর দৃষ্টিতে সে-ই সবচেয়ে সম্মানিত।
কাজেই
দীনের জ্ঞান নেওয়ার আগে অবশ্যই শিক্ষকের যোগ্যতা যাচাই করতে হবে। কারণ একজন জ্ঞান
অন্বেষণকারীর জন্য এটা জীবন-মরণের প্রশ্ন নয়; এটা পরকালীন জীবনের প্রশ্ন।
ঠিক-বেঠিকের
মধ্যে পার্থক্য করা একজন সাধারণ মানুষের জন্য খুবই কঠিন একটা ব্যাপার। বিশেষ করে
তারা যদি এমন কোনো বাকপটু তর্কবাগীশ লোকের ফাঁদে পড়েন যিনি খুব ভালো করেই জানেন
কীভাবে তর্কে জিততে হয়। কিংবা এমন কোনো লোক যিনি কথার মাধ্যমে নিজেকে ‘আলিম হিসেবে
মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারেন। এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে যেখানে হাজার হাজার
সাধারণ মানুষ ভেড়ার পালের একদল ভেড়ার মতো এসব প্রতারণাকারীদের অনুসরণ করছে। অনুসরণ
করতে করতে ভেড়াগুলো যে নিজেরাই স্বেচ্ছায় কসাইখানায় ঢুকছে সে ব্যাপারে এদের কোনো
চিন্তা নেই। কথিত এসব ‘আলিমগণ নিজেরাই বিভ্রান্ত। আপনার পকেট থেকে টাকা খসানোর
জন্য তারা এমন সব কথা বলবে যেগুলোকে আপনার কাছে খুবই যৌক্তিক মনে হবে। কারণ আপনার
নিজের নাফ্সেরই যেখানে পরিচর্যা প্রয়োজন, সেখানে ভ্রান্ত স্কলারদের এ ধরনের কথাবার্তা
আপনার ব্যক্তিগত কামনাকে আরও উসকে দেবে। আর একারণেই অনেক লোক এমন সব ‘আলিমদেরই
খোঁজে যারা তাদের কামনা পূরণে সহায়তা করে, তারা যা করতে
চায় সেগুলোকে ‘অনুমোদন’ দেয়, বিভিন্ন ইসলামিক আইনের
ফাঁকফোকর খুঁজতে সাহায্য করে—যদিও ইসলামিক আইনে কোনো ফাঁকফোকর নেই।
দৃষ্টান্তস্বরূপ
সেসকল ‘আলিমদের কথা বলা যায় যারা ইসলামের নামে সংগীত, নাচ এবং খ্রিষ্টান
রিভাইভালিস্টদের ইঙ্গিতবাহী বিভিন্ন রীতিনীতির অনুমোদন দেয়। কোনো হারামকে হালাল
বললেই তা হালাল হয়ে যায় না। মূলত এর ফলে যা হয়, বিচক্ষণ ও
বোধসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে এসব কথিত ‘আলিমদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায়। অবশ্য কেউ
যদি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেদের চোখ বন্ধ করে রাখে তাদের কথা আলাদা।
মূল লেখাঃ মীর্জা ইয়াওয়ার বেইগ
(চলবে)
No comments:
Post a Comment